ঈশ্বর প্রত্যেক মানুষকে দেহ, মন ও আত্মা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। দেহ, মন ও আত্মা-এই তিনটি মিলে একজন মানুষ। এই তিনটি বিষয় একসাথে আছে বলেই আমরা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছি। যদি কোনো কারণে তিনটির মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যে তিন-এর সমন্বিত কাজ অনবরত ঘটে চলছে। অথচ আমরা সে বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকি না। এই অধ্যায়ে আমাদের দেহ, মন ও আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করে আমরা নিজ নিজ দেহ, মন ও আত্মাকে শ্রদ্ধা করব। তাদের জন্য ঈশ্বরের প্রশংসা করব।
আমাদের দেহ, মন ও আত্মা আছে। দেহকে আমরা দেখতে ও স্পর্শ করতে পারি। কিন্তু মন ও আত্মাকে দেখতে ও স্পর্শ করতে পারি না। আমাদের দেহটা নশ্বর অর্থাৎ এই দেহ একদিন মৃত্যুবরণ করবে ও নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের আত্মা অবিনশ্বর বা অমর । তার কোনো বিনাশ নেই। মৃত্যুর সময় আত্মাটা ঈশ্বরের কাছে চলে যাবে। তখন ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নেবেন আমাদের আত্মার স্থান কি স্বর্গে হবে না কি নরকে হবে। দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হলে মনের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে আমাদের মরণশীল দেহের মধ্যে অমূল্য একটি দান অর্থাৎ আমাদের অমর আত্মা বাস করছে।
আমাদের দেহ, মন ও আত্মার একতা বোঝার জন্য আমরা নিজেদের আম, লিচু ইত্যাদি বিভিন্ন ফলের সাথে তুলনা করতে পারি।
ফল | মানুষ |
---|---|
১। আম, লিচু ইত্যাদি ফলের চামড়া বা খোসা, মাংস ও বীজ থাকে। | ১। মানুষের দেহ, মন ও আত্মা আছে। |
২। খোসা, মাংস ও বীজের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা। | ২। দেহ, মন ও আত্মার কাজ সম্পূর্ণ আলাদা। |
৩। খোসা, মাংস ও বীজ একসাথে যুক্ত না থাকলে পূর্ণ ফল তৈরি হয় না । | ৩। দেহ, মন ও আত্মা একসাথে যুক্ত না থাকলে পূর্ণ মানুষ তৈরি হয় না। |
৪। তিনটি জিনিস একটা থেকে অন্যটা আলাদা হলে মরে যায়, গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। | ৪। দেহ, মন ও আত্মা আলাদা হয়ে গেলে মানুষ আর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। |
৫। ফলগুলো জীবন পায় গাছ থেকে। গাছের সাথে যুক্ত না থাকলে তারা নষ্ট হয়ে যায়। | ৫। মানুষ যুক্ত থাকে তার ঈশ্বরের সাথে। ঈশ্বরের সহায়তা ছাড়া সে জীবিত থাকতে পারে না । |
৬। ফলের সার্থকতা আসে নিজেকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে । | ৬। মানুষেরও পূর্ণতা আসে নিজেকে ঈশ্বর ও মানুষের সেবায় উৎসর্গ করার মাধ্যমে। |
উপরের এই তুলনাগুলো দেওয়া হয়েছে শুধু আমাদের দেহ, মন ও আত্মার একটি মিল দেখার জন্য। তার অর্থ এই নয় যে মানুষ সব দিক দিয়ে ফলের মতোই। প্রকৃতপক্ষে মানুষ হলো সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মানুষ সব প্রাণীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এর কারণ হলো, মানুষের বুদ্ধি আছে। বুদ্ধি না থাকলে মানুষ সাধারণ জড়বস্তুর মতোই হতো। বুদ্ধিবৃত্তি আছে বলে মানুষ অন্য সকল প্রাণী থেকে আলাদা। অন্য প্রাণীরও কিছু বুদ্ধি আছে। কিন্তু তারা জানে না যে তাদের বুদ্ধি আছে। মানুষ জানে যে তার বুদ্ধি আছে। এই কারণে মানুষ সকল প্রাণীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
শুধু সব প্রাণীর মধ্যেই মানুষ শ্রেষ্ঠ নয়-পৃথিবীর সকল দৃশ্য ও অদৃশ্য সকল সৃষ্টির মধ্যেও মানুষ শ্রেষ্ঠ। এর কারণ হলো, ঈশ্বর নিজেই মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন; তাকে স্থান দিয়েছেন সকল সৃষ্টির উপরে। কারণ ঈশ্বর মানুষকে নিজের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মধ্যে তিনি অমর আত্মা দিয়েছেন।
ঈশ্বরের শক্তিতে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে -
দেহ, মন ও আত্মাবিশিষ্ট মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতো খাওয়া-দাওয়া, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন করা ছাড়া আরও অনেক কিছুই করতে পারে। যেমন-
১। প্রধানত দেহ ব্যবহার করে মানুষ উন্নয়নমূলক কাজ, সুন্দর সুন্দর কৌশলপূর্ণ খেলাধুলা, অন্যের জন্য দয়ার কাজ ইত্যাদি করতে পারে। সে নতুন কিছু গড়তেও পারে আবার ধ্বংসও করতে পারে।
২। প্রধানত মন দিয়ে মানুষ চিন্তা, পরিকল্পনা, পড়াশুনা, পরামর্শদান, নতুন কিছু আবিষ্কার ইত্যাদি করতে পারে। সে ভালো চিন্তাও করতে পারে আবার মন্দ চিন্তাও করতে পারে। যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসও করতে পারে আবার অবিশ্বাসও করতে পারে।
৩। প্রধানত আত্মার শক্তিতে মানুষ ঈশ্বরের উপস্থিতি দেখতে পায় ও তাঁকে অনুভব করতে পারে, ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারে, পবিত্রতা অর্জন করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানুষ সচেতনভাবে যা করে তার মধ্যে কোনো-না- কোনোভাবে তার দেহ, মন ও আত্মা-তিনটাই জড়িত থাকে। মানুষ নিজের থেকে কিছুই করতে পারে না। সে যা করে তা ঈশ্বরের দেওয়া শক্তিতেই করে ৷
ঈশ্বর সবকিছু দেখেন ও পরিচালনা করেন
ঈশ্বর একই সময়ে সব জায়গায় আছেন। তিনি এই মুহূর্তে যেমন এখানে ও আমার মধ্যে আছেন, তেমনি পৃথিবীর সব স্থানে ও সব মানুষের মধ্যে আছেন। তিনি সবকিছু জানেন ও দেখেন। জগতের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যা-কিছু ঘটেছে, সবই তিনি জানেন । ভবিষ্যতে কী কী ঘটবে, তা তিনি জানেন। আমরা যা বলি, চিন্তা করি বা কল্পনা করি তা তিনি জানেন ও দেখেন। তিনি সবসময় আমাদের দেহ, মন ও আত্মার সবকিছুই দেখেন ও জানেন। আমরা যদি গোপনে কিছু চিন্তা করি বা লুকিয়ে কোনো কাজ করি তাও তিনি দেখেন ও জানেন। তাঁর কাছে কোনোকিছুই গোপন করা যায় না। আমি যদি কোনো মানুষকে না দেখিয়ে মাটির নিচে কোনো জিনিস পুঁতে রাখি তাও তিনি দেখতে পান ও জানতে পারেন। আমরা হয়তো মানুষের চোখ এড়াতে পারি কিন্তু ঈশ্বরের চোখ কোনোভাবেই এড়াতে পারি না।
প্রবক্তা জেরেমিয়ার (যিরমিয়র) মধ্য দিয়ে ঈশ্বর নিজেই বলেন, “আমি কি শুধু কাছেরই ঈশ্বর? আমি কি দূরের ঈশ্বরও নই? কেউ কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকলে আমি কি তাকে দেখতে পাই না? আমি কি স্বর্গমর্ত জুড়েই নেই?” (জেরে ২৩:২৩-২৪)
ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও মহান
‘ঈশ্বর সর্বশক্তিমান' এই কথার অর্থ হলো ঈশ্বর তাঁর নিজ শক্তি দ্বারা সবই করতে পারেন। তাঁর অসাধ্য কিছুই নেই। দুই চোখ দিয়ে আমরা যা কিছু দেখি ও অনুভব করি, তা সবই ঈশ্বর নিজের শক্তিতে সৃষ্টি করেছেন। তিনি এত শক্তিমান যে, শুধু মুখের কথার দ্বারাই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। আমরা জানি, ঈশ্বরের পুত্র যীশু খ্রিষ্ট পূর্ণ মানব হলেও তিনি আবার পূর্ণ ঈশ্বর। ঈশ্বর হয়েও কীভাবে তিনি মানুষ হলেন। কতো আশ্চর্য কাজ করলেন। মৃত্যুবরণ করেও পুনরুত্থান করলেন। এগুলো তাঁর শক্তিরই প্রকাশ। ঈশ্বরের পক্ষে কোনো কিছুই অসাধ্য নয়।
ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মান
ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তাঁর গৌরবের জন্য। এই কারণেই আমরা দেখি সমস্ত সৃষ্টি তাঁর বন্দনা ও প্রশংসায় মুখর। আমরা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কাজেই আমরা আমাদের চিন্তা, কথা ও কাজ তথা সারাটা জীবন দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি আমাদের ভক্তিশ্রদ্ধা, সম্মান, প্রশংসা ও বন্দনা করব। কারণ এটি আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। যেভাবে আমরা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতে পারি তা নিম্নে দেওয়া হলো:
১। সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে ঈশ্বরকেই ভালোবাসা যায়। সকল মানুষকে ভালোবেসে এমনকি শত্রুদেরও ক্ষমা করে ও ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মানের বাস্তব প্রকাশ ঘটাতে পারি ।
২। ঈশ্বরের অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি যথাযথ যত্নশীল হয়ে আমরা ঈশ্বরকে সম্মান শ্রদ্ধা করতে পারি ।
৩। পিতামাতা ও অন্যান্য গুরুজনদের প্রতি বাধ্য থেকে ও ভালোবাসা প্রকাশ করে আমরা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি। বাধ্যতা হলো ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মানেরই প্রকাশ ।
৪। দীনদরিদ্র, অবহেলিত, অসুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিয়ে আমরা ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান দেখিয়ে থাকি। কারণ যীশু তাদের মাঝে আছেন ।
৫। ঈশ্বরের পুত্র যীশুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা ঈশ্বরের প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শন করি। পিতা ঈশ্বর আমাদের সামনে তাঁর পুত্রকে আদর্শ হিসাবে দিয়েছেন।
৬। প্রতিদিন প্রার্থনা, ধ্যান ও উপাসনার মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রশংসাকীর্তন করে আমরা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে থাকি ।
৭। সর্বদা সৎপথে চলার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের উৎস ঈশ্বরের প্রতিই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি। কেননা সৎপথে চলার মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করি যে আমরা ঈশ্বরের সন্তান।
ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও মহান। তিনি সবকিছু দেখেন ও পরিচালনা করেন। ঈশ্বরকে আমরা ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাব। কারণ তিনিই তো আমাদেরকে দেহ, মন ও আত্মা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
পরিকল্পিত কাজ
তিনটি বৃত্ত এঁকে, একটার সাথে আর একটা সংযুক্ত করে তার ভিতরে দেহ, মন ও আত্মা লেখ ।
(ক) আমাদের আত্মা ___।
(খ) মানুষের দেহ, মন ও ___ আছে।
(গ) মানুষ সব প্রাণীর মধ্যে ___।
(ঘ) আত্মার শক্তিতে মানুষ ঈশ্বরের ___ দেখতে পায়।
(ঙ) ঈশ্বর তাঁর নিজ শক্তি দ্বারা ___ করতে পারেন।
ক) দেহ, মন ও আত্মা | ক) মনটার আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না । |
খ) দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হলে | খ) তাঁর গৌরবের জন্য। |
গ) প্রকৃতপক্ষে মানুষ হলো | গ) তাঁর বুদ্ধি আছে। |
ঘ) মানুষ জানে যে | ঘ) প্রশংসায় মুখর। |
ঙ) ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন | ঙ) এই তিনটি মিলে একজন মানুষ। |
চ) সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ । |
ক) কার সহায়তায় মানুষ জীবিত থাকতে পারে ?
খ) মন দিয়ে মানুষ কী কী করতে পারে?
গ) মানুষ সচেতনভাবে যা করে তার মধ্যে কী কী জড়িত থাকে?
ঘ) জগতের শুরু থেকে যা কিছু ঘটেছে তা কে জানেন ?
ক) ঈশ্বর কীভাবে দেখেন ও পরিচালনা করেন ?
খ) ঈশ্বরের শক্তিতে মানুষ কী কী করতে পারে ?
গ) দেহ, মন ও আত্মার কাজ কী কী?
Read more